কলকাতার বাংলাকে যদি "কেলু ভাষা" বলি...

সুমিত দে
(ভাষাঃ বাংলা)
২৬ এপ্রিল ২০২০


কলকাতার মানুষের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো তারা জেলার মানুষের মুখে শোনা বাংলা সহ্য করতে পারেন না। আপনি যত ভালো উচ্চারণেই বাংলা বলুন তবুও বলবে আপনার উচ্চারণে সমস্যা রয়েছে। এই একই কথা বারবার বলে তারা জেলার মানুষদের অপমান করে বাংলা ভাষার সর্বনাশ করছেন আর একই জিনিস ভোজপুরি বা হিন্দিতে বললে তারা স্বর্গসুখ পান। আমাদের ভাষাতে যদি একটু আঞ্চলিক টান থাকেই তাতে কলকাতার মানুষের অতো সমস্যা কেন? আজকে পুরুলিয়ার মানুষ যে বাংলা বলবে সেটাও কলকাতার মানুষকে মানতে হবে। একজন মেদিনীপুরের ছেলেও যে বাংলা বলে সেটাও কলকাতার মানুষকে মানতে হবে। শুধু কলকাতার ভাষাই আসল বাংলা নয়। পশ্চিমবঙ্গ শুধু কলকাতা নিয়েই গঠিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক, বাংলাদেশের সকল মানুষ যে বাংলা বলে সেটাও বাংলা। এবার যদি বলতে হয় কলকাতাই একমাত্র বাংলা ভাষার পীঠস্থান, তাহলে বলতে হবে এখন এই কলকাতার বুকেই বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সংকটের মুখে। কলকাতার বাসে-ট্রেনে আর মেট্রোতে আজ বাংলা শোনা যায়না। বড়বাজার বা একাধিক জায়গাতে আজ বাংলা লিপি মুছে গেছে। সল্টলেকের অফিসগুলোতে বাংলা ভাষা মুছে ফেলা হয়েছে। জোঁড়াসাঁকো আজ অবাঙালিদের দখলে। বিশ্ববাংলা গেটের নীচে দিব্যি হিন্দি চলে। আর ফুটপাথ সেতো কবেই দখল হয়ে গেছে। ব্যবসার কথা তো ছেড়েই দিলাম৷ আর আপনাদের বাংলোগুলো এক এক করে চলে যাচ্ছে বহিরাগত বেনিয়াদের হাতে। নতুন ফ্ল্যাটগুলোতে আপনাদের জায়গা হচ্ছে না। পুরানো ফ্ল্যাটগুলোতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা প্রতিদিন বহিরাগতদের হাতে খুন হচ্ছেন। দোল তো এখন হোলী হয়ে গেছে। দীপাবলি হয়ে গেছে দেওয়ালিতে রূপান্তর। আপনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছেন হিন্দি ভার্সনে। বাংলা ছবি দেখলে নাক সিঁটকাচ্ছেন। থিয়েটারের মধ্যে আপনারা চালাচ্ছেন ইউরোপ মেনিয়া। বহিরাগতদের ডিজে-রাপ গানে আপনি করেন বড়দিনের নৃত্য। কফিহাউসেও বাংলা শোনা যাচ্ছে না। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা বললে ফাইন কাটা হচ্ছে। সারা বাংলা তো দূর, কলকাতার এয়ারপোর্টে আজ কোনো বাংলা বই বিক্রি হয়না। অথচ একটা গ্রামে প্রতিটি গলির মোড়ে বাংলা বই বিক্রি হয়।

কলকাতার বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো এখন ধুঁকছে। কোনো কোনো অফিসে বলা হচ্ছে আমরা বাঙালি চাকুরি প্রার্থী নিই না। তবুও আপনারা এসব মুখ বুজে সহ্য করছেন। অন্য জাতির গোলাম হওয়ার চেষ্টা করছেন। আপনাকে বাংলা শুনতে হলে যেতে হবে পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা বা মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে। যদি প্রত্যেকটি আঞ্চলিক বাংলার সমান গুরুত্ব থাকতো তাহলে শরৎচন্দ্রের মহেশ,সিলেটের বাংলা, বীরভূমের বড়লোকের বিটি লো, চাটগাঁইয়ার গান, সুন্দরবনের লোকগীতি এরকম হাজারটা সাহিত্য রচিত হতে পারতো। সুতরাং মেদিনীপুরের লোককে টুম্পা, বাঁকুড়ার লোককে বাঁকড়ি বলে সম্বোধন করা হয়। মার্জিত বাংলা ভাষার সংশাপত্র দেওয়ার অধিকার শুধু আপনাদের ওপরই বর্শায় না। বরং একটা প্রান্তিক চাষী বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে। তাই সেই প্রান্তিক চাষীটিকে ছোটো করার অধিকার আপনাকে কে দিল? একইভাবে যদি জেলার লোক কলকাতার বাংলাকে কেলু ভাষা বলা চালু করে আপনাদের তখন কেমন লাগবে? এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি, ইংরেজি ভাষার কথা যদি বলা হয়, তাদের অভিধানে প্রতিটি আঞ্চলিক ইংরেজির প্রতিশব্দ দেওয়া থাকে। তাই তাদের ভাষার ব্যপ্তি সমান তালে বজায় থাকে।

এবার একটি উদাহরণের কথাই আসা যাক, ধরুণ 'মিথ্যা কথা' এই শব্দটিকে ধরে নিলাম মার্জিত শব্দ সেক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত 'মিছা কথা', 'প্যাঁদা কথা' এই দুটো শব্দ গুরুত্ব হারায়। ফলে মিথ্যা কথার আগ্রাসনে 'মিছা কথা' ও 'প্যাঁদা কথা' দুটি শব্দ হারিয়ে যেতে পারে। তার মানে আদপে কী বাংলা ভাষার উন্নয়ন হলো? বরং আপনারা দুটো শব্দকে হারিয়ে বাংলা ভাষা থেকে দুটো শব্দ বিলুপ্তর দিকে ঠেলে দিলেন। যেটা বাংলা ভাষার চরমতর ক্ষতি।

মেকি বাঙালিয়ানা দেখানোর জন্য সে আপনাদের কতই না নাটক। আপনারা বাংলা ভাষা রক্ষা তো দূরের কথা জেলার বাঙালিদের 'স' ও 'শ' এর উচ্চারণ দেখতেই আপনাদের অর্ধেক জীবন কেটে যায়। দয়া করে বাংলা ভাষার সংশাপত্র আপনারা দেবেন না।

(লেখকঃ সুমিত দে)

ছবি