১৯শে মে - বিশ্বের প্রথম মহিলা বাংলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্যের মৃত্যুদিন
মনন মণ্ডল
(ভাষাঃ বাংলা)
১৯ মে ২০২০
আজকের অসম রাজ্য ব্রিটিশদের সৃষ্টি। বাঙালির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বানচাল করতে এবং অসমকে রাজস্ব আদায়ের উপযোগী করতে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৪ সালে "অসম" রাজ্য গঠন করে এবং কাছাড়, গোয়ালপাড়া সহ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে অসমের সাথে যুক্ত করে দেয়। ১৯৪৭ সালে শিলচর বা বরাক উপত্যাকা বাংলা থেকে ভেঙে অসমে যুক্ত করা হয়। অসমের ইতিহাস বলছে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিস্তীর্ণ এলাকা একসময় নিষাদ কারাত বোর কোর ইত্যাদি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ছিল। মূলত নিষাদ ও কারাত জনজাতি এখনকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী। বোর জনগোষ্ঠীর মানুষরা নিজেদের "ডিমাছা" অর্থাৎ "ব্রহ্মপুত্রের সন্তান" বলে। সপ্তদশ শতক থেকেই অসমের সরকারি ভাষা বাংলা ছিল অথচ ১৯৫১ সালের অসম জনগণনায় যখন দেখা যায় বাঙালিরা অসমে ভাষাগত সংখ্যাগুরু তখন অসমিয়া ভাষাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য বিপুল কারচুপি করা হয়। ১৯৬০ সালে অসম বিধানসভায় পাশ করানো হয় বাংলা ভাষা বিরোধী বিল যেখানে বলা হয় অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে অসমিয়া। বাংলা ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা হারায়। বাংলা মাধ্যমের স্কুল, কলেজ ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ বাঙালির বাংলা মাধ্যমে চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভয়াবহ অত্যাচারের মুখোমুখি হয় অসমের বাঙালি জাতি তথা সমস্ত অ-অসমীয়া জাতি। মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করতে বাঙালি সহ প্রায় সমস্ত অ-অসমীয়া জাতিগুলি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেয়। বাংলা ভাষার অস্থিত্ব রক্ষার্থে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন বাঙালি শহিদ হন অসম রাইফেলসের গুলিতে। তলিকায় ছিলেন বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য। তারপর বাঙালি জাতি বিদ্বেষীরা ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিলাপাথরে গণহত্যা চালায়। যার ফলে প্রাণ হারান ৫০ জনের বেশি বাঙালি। তার ঠিক কয়েকদিন পরে অসমের নেলীতে আবার গণহত্যা চালায় বাঙালি জাতি বিদ্বেষীরা যার ফলে প্রাণ হারান দুই হাজারের বেশি বাঙালি। এছাড়াও অসমে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় বাঙালির ওপর বহু অত্যাচার নেমে এসেছে।
১৯৫১-র NRC অত্যাচারের পর ১৭ই ডিসেম্বর ২০১৪, সুপ্রিম কোর্টের বিচাপতি রঞ্জন গগৈ (অসমীয়া) অসমে NRC'র নির্দেশ দেন। এবং পুরস্কার স্বরূপ অবসরের ৪ মাসের মধ্যেই রাজ্যসভার সদস্যপদ পেয়ে যান মোদি মন্ত্রীসভার সুপারিশে। গত ৫ বছর ধরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে অসমে NRC'র কাজ চলে। ২০১৭ সালের ৩০শে ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম NRC তালিকা অনুযায়ী ১ কোটি ৩৯ লক্ষ বাঙালির নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৩০শে জুন অসম সরকার দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করে যেখানে ৪০ লক্ষ বাঙালির নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। গত ৩০ আগস্ট ২০১৯ তারিখে NRC'র যে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয় তাতে দেখা যায় ১৯ লক্ষ বাঙালী নাগরিককে রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে, তারমধ্যে ১৩ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ও ৫ লক্ষ মুসলমান বাঙালি। এবারের এনআরসি তালিকা নতুন একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে "অরিজিনাল ইনহেবিটেন্ট"। যার মাধ্যমে শুধুমাত্র বাঙালিকেই লাইনে দাঁড়িয়ে হয়রানি সহ্য করে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে কোনো অসমীয়াকে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে না। NRC আতঙ্কে অসমে একশোর বেশি বাঙালি আত্মহত্যা করেছে। লক্ষ লক্ষ পরিবারের এক বা দুজন করে সদস্যের নাম NRC তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ফলে অসমের প্রায় প্রত্যেকটি বাঙালি পরিবার আজ দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। অসমের হাজার হাজার ভূমিপুত্র বাঙালি আজ ডিটেনশন ক্যাম্পে পচে মরছেন। তাদের সমাজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আজকে অসমে একর্ডের ৬ নম্বর ধারা যদি লাগু করা হয় তাহলে সেখানকার ভূমিপুত্র বাঙালি জমি ব্যবসা লাইসেন্স থেকে শুরু করে ভোটে লড়াই, এক কথায় সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হারাবেন। শোনা যাচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ চক্রান্তে অসমে অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে এবং অসমের জমি কোন অ-অসমীয়া কিনতে পারবে না এই ধরনের আইন আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পূর্বোত্তর রাজ্যগুলিকে ষষ্ঠ তপশীল এর আওতায় এনে এবং ইনার লাইন পারমিট চালু করে সেখানে বাঙালীদের খেদানোর রাস্তা পরিষ্কার করা হচ্ছে। প্রথমেই NRC'র মত আইন করে বাঙালীদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো হবে। তারপর ষষ্ঠ তপশিল এবং ইনার লাইন পারমিট লাগু করে তাদের CAA'র মাধ্যমেও নাগরিকত্ব ফেরানো হবে না। আসল টার্গেট ভারতের প্রত্যেক প্রান্ত থেকে বাঙালিকে রাষ্ট্রহীন করো। ইতিমধেই সেখানে বাঙালিরা সংখ্যাগুরু হলেও অসমীয়া ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা চলছে। আইন করে সারা ভারত থেকে বাঙালীদের বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর বা ডিটেনশন ক্যাম্পে পচিয়ে মারার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অস্থিত্বের প্রয়োজনে বাঙালীকে জাতি হিসাবে এক হতে হবে।
(লেখাঃ মনন মণ্ডল)